আজিজ বেনজীরকে এমন পিএইচডি কীভাবে দিল বিশ্ববিদ্যালয়?

 আজিজ বেনজীরকে এমন পিএইচডি কীভাবে দিল বিশ্ববিদ্যালয়?

বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের কর্মদক্ষতা ও মানবহিতৈষী কাজের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি বা অনারারি ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের অনেক গুণী ব্যক্তি এই ধরনের ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। এসব ডিগ্রির মূল্যায়ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে শত পিএইচডির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তবে, আমাদের দেশে কিছু ব্যক্তি ক্ষমতায় থাকাকালে এই ধরনের সম্মান পাওয়ার সম্ভাবনা কম হওয়ায় একাডেমিকভাবে পিএইচডি নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নামের আগে 'ড.' লেখার ইচ্ছায় এসব ডিগ্রি এখন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতা ভালো সংবাদ যে সরকারি কর্মকর্তারা একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য 'প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ' নামে একটি ফেলোশিপ চালু করা হয়েছে, যা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সব খরচ মেটায়।
n nn
যদিও অনেক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে এলে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার সনদসহ নানা শর্ত পূরণের প্রয়োজন পড়ে, দেশের অনেক কর্মকর্তা চাকরিরত অবস্থায় দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। ভর্তির নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই জ্ঞান অন্বেষণের স্বাদ নিচ্ছেন, যা সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায় কিছু ঘটনার দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ জমি কেনা ও দুর্নীতির কারণে আলোচনা এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে নেওয়া তাঁর ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) ডিগ্রির ভর্তি জালিয়াতির খবরও প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য তাঁকে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল।

তাঁর তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, যিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যানও, সুপারিশপত্রে লিখেছেন, বেনজীর ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার ও র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাঁর ডিবিএ প্রোগ্রামে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির অনুমতি দেশের কল্যাণে কাজে আসবে।

কিন্তু সম্প্রতি তাঁর দুর্নীতি ও সম্পদলোভীর ঘটনা দেশবাসী জানতে পেরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রামের ভর্তিযোগ্যতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্নের দায় বিশ্ববিদ্যালয় এড়াতে পারে না।
n nn
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ভর্তির কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তিতে তিন–চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। চার বছর মেয়াদি পিএইচডি কোর্সে চাকরিরতদের কমপক্ষে এক বছরের শিক্ষাছুটি নিতে হবে। খণ্ডকালীন কোর্সে ভর্তি হলে 'নিয়োগকর্তার' অনুমতি নিতে হবে। বেনজীর আহমেদ নিয়মিত না খণ্ডকালীন কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন, তা জানি না। তবে চাকরিরত অবস্থায় তিনি শিক্ষাছুটি নিয়েছিলেন কিনা, সেটাও স্পষ্ট নয়।

পিএইচডি/ডিবিএ গবেষকদের ন্যূনতম দুটি উন্মুক্ত সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে হয়। বেনজীর আহমেদের ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার আগে এই সেমিনারে ঠিক কারা উপস্থিত ছিলেন, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অবদানের ওপর তাঁর গবেষণায় কী ধরনের নতুনত্ব বা মৌলিকত্ব ছিল, তা বোধগম্য না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরনের যৌগিক তত্ত্বে পিএইচডি বা ডিবিএ ডিগ্রি প্রদান করেছে। অথচ পিএইচডির মূলনীতি হলো নতুন জ্ঞান বা গবেষণায় মৌলিকত্ব থাকা।
ঠিক একই পথে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। ২০২০ সালের শেষ দিকে সেনাপ্রধান থাকাকালে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে ‘সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ: আন্তর্দেশীয় ঝুঁকির বিষয়’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ।

দৈনিক কালের কণ্ঠে ২০১৮ সালের ১৯ জুন প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, আজিজ আহমেদ ১৯৭৫ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৭ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৮১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৩ সালের ১০ জুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করেন এবং একই বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (পাস) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার অব ডিফেন্স স্টাডিজ (এমডিএস) ডিগ্রি অর্জন করেন।
nn n
বেনজীর আহমেদের মতো তিনিও স্নাতক ডিগ্রি ছাড়াই বিএ ডিগ্রি নিয়েই বিইউপির ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। বিইউপির পিএইচডি ভর্তির শর্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, তিন বা চার বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রি এবং দুই বা এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে, পাশাপাশি দুটি প্রকাশনা থাকতে হবে। আজিজ আহমেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকুক না থাকুক, তাঁর তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে। 

তাঁর পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তৎকালীন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, যিনি ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বিইউপির উপ-উপাচার্য ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ২০১৭ সালের ১ জুন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় । 

প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের সাধারণত গবেষণা করানোর সুযোগ সীমিত থাকে, আর উপাচার্য হয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হওয়া একধরনের 'অবৈধ আবদার' বলেই মনে হয়। আজিজ আহমেদের পিএইচডি বৈধ না অবৈধ, সে প্রশ্ন না তুললেও, যে প্রক্রিয়ায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। 
n nn
একজন ব্যক্তি সরকারি চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশের কোন উন্নয়নে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন, তা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন। আপাতত, বেনজীর আহমেদ ও আজিজ আহমেদের এসব পিএইচডি–প্রীতি বন্ধ হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন ক্ষমতাধারীদের যেকোনোভাবে ডিগ্রি ম্যানেজ করে দিয়ে দায় এড়িয়ে না যায়। তাঁদের জবাবদিহি জনগণের সামনে আনা উচিত, মনে রাখতে হবে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো জনগণের করের পয়সায় সচল।


Post a Comment

0 Comments