সরকারি চাকরি কি সত্যিই আলাদিনের চেরাগ?

সরকারি চাকরি কি সত্যিই আলাদিনের চেরাগ?

লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে—ছেলেবেলায় এই ‘ভুল’ কথাটি শেখানো হয় আমাদের। বারবার শুনে এই ‘ভুল’ কথাটিই আমাদের মাথায় গেঁথে যায়। এখন তো আর ঘোড়া কেনার চল নেই। গাড়ি-বাড়ি, ভোগ বিলাসকেই আমরা ‘লাইফের লক্ষ্য’ বানিয়ে নিয়েছি।

মানুষের ইচ্ছাপূরণের প্রতীক হয়ে আছে আলাদিনের চেরাগ। নিজের যোগ্যতায় নয়, অলৌকিক কিছুর সাহায্যে সহজেই জীবন বদলে ফেলতে চায় মানুষ। পৃথিবীর সব ভাষায় সবদেশে তাই এমন ইচ্ছাপূরণের প্রতীক হয়ে আছে আলাদিনের চেরাগ ও তার দৈত্য।
সরকারি চাকরি কি আলাদিনের চেরাগ যে ঘষা দিলেই বেরিয়ে আসবে ইচ্ছা পূরণের দৈত্য? একসময় ‘লাইফের লক্ষ্য' হিসেবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকতার কথা লেখা হতো। এখন কী লেখা হয় জানি না। তবে এখন বেশিরভাগই সরকারি চাকরি করতে চায়। বিয়ের বাজারে বিসিএস ক্যাডারের চাহিদা এখন সবার ওপরে। কেন সবার ওপরে? সরকারি চাকরির বেতন কি সবচেয়ে বেশি? সরকারি চাকুরেদের বেতন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে বটে, তবে সবচেয়ে বেশি নয়। তারপরও চাহিদায় সবার ওপরে, কারণ, সরকারি চাকরিতে ক্ষমতা আছে, আর সেই ক্ষমতা অপব্যবহার করে অঢেল সম্পদ অর্জনের সুযোগ। মানে, সরকারি চাকরি করলে আপনি ‘গাড়ি-ঘোড়া' চড়তে পারবেন আরামসে। সরকারি চাকরি মানেই যেন আলাদিনের চেরাগ, ঘষা দিলেই টাকা চলে আসবে।
তবে সব সরকারি চাকরি আবার একই রকম নয়। কদিন আগে আদনান ফেরদৌস নামে এক সরকারি চাকুরে তার চাকরি বদল করেছেন। বিসিএস তথ্য ক্যাডারের আদনান ফেরদৌস বাংলাদেশ বেতারের সহকারী বেতার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু তিনি আরেক দফা চেষ্টায় নন-ক্যাডার সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আদনান ফেরদৌস ক্যাডার পদ ছেড়ে নন-ক্যাডার পদে যোগ দিয়েছেন। তার নতুন পদের সম্মান পুরোনো পদের চেয়ে অনেক কম, বেতন তো অবশ্যই কম। নতুন চেয়ারে বসে তার পুরোনো চেয়ারকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে। তারপরও তিনি কেন সম্মান, বেতনের পরোয়া না করে নিম্ন পদটাকেই বেছে নিলেন? কারণ, নতুন পদে ‘উপরি' আয়ের সুযোগ অনেক বেশি। আদনান ফেরদৌসকে দিয়ে ‘ছিলাম বোকা হইলাম বুদ্ধিমান'এর নতুন ভার্সন বানানো সম্ভব। ‘উপরি' আয়ের আশায় ‘ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদের মতো বিশেষায়িত একাডেমিক ক্যারিয়ারের লোকজনও বিসিএস দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ বা কাস্টমসে যোগ দিতে চান।
এই চাওয়াটা এখন সহজ এবং সবাই অনায়াসে তা মেনেও নিয়েছেন। দুর্নীতির এক ধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা বেতনের সরকারি চাকুরে যখন বাসা ভাড়া দেন ৬০ হাজার টাকা, সন্তানকে দেশে ইংলিশ মিডিয়াম বা বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠান; আমরা কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুলি না। বরং সেই কর্মকর্তাকে বেশ ‘কামেল' মনে করি। বিয়ের কথা-বার্তায় মেয়ের বাবা অনায়াসে ছেলের উপরি আয় কেমন সেটা জানতে চান। সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ যদি শেষ জীবন কাটানোর জন্য গ্রামে ২০ বিঘা জমির ওপরে একটা বাগান-বাড়ি করতেন, আমার ধারণা কেউ তেমন কিছু মনে করতো না। সম্পত্তির হিসাব হাজার বিঘা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই এত আলোচনা। পাপের পেয়ালা পূর্ণ হলে তা উপচে পড়ে। প্রকৃতিরও একটা বিচার আছে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না।
সরকারি চাকুরে সবাই কি ঘুষ খান, দুর্নীতি করেন? এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগতভাবে অনেক সৎ কর্মকর্তাকে আমি চিনি, সুযোগ থাকা সত্বেও যারা দুর্নীতি করেন না। আবার অনেকে সুযোগের অভাবে সৎ। যেমন আদনান ফেরদৌস নিশ্চয়ই এতদিন সৎ ছিলেন। সহকারী বেতার প্রকৌশলীর তো দুর্নীতির সুযোগ নেই। এখন সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে তার নতুন ক্যারিয়ার শুরু হবে দুর্নীতিকে লক্ষ্য করেই।
তবে আমাদের পুরো সিস্টেমটা এমনভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, ভালো মানুষদের এখানে টিকে থাকাই মুশকিল। স্বাস্থ্যের কেনাকাটা, থানা, ভূমি অফিস, পূর্ত বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে ঘুষের রেট করা আছে। এটা একটা চেইনের মতো। মাঝখানে একজন যদি ঘুষ নিতে না চান, তাহলে সেই চেইনটা ভেঙে পড়ে। সেই সৎ কর্মকর্তার সহকর্মীরাই তাকে হয় ঘুষ সিন্ডিকেটে ঢুকিয়ে ফেলেন, নয় জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেন।
আচ্ছা পুলিশে কি বেনজীর একাই দুর্নীতিবাজ বা এনবিআরে কি মতিউর রহমান একজনই? বেনজীর বা মতিউর যত ক্ষমতাশালীই হোন, তাদের পক্ষে একা দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। দুর্নীতি করতে সঙ্গী লাগে। বেনজীর যখন ধারাবাহিকভাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, র‌্যাবের মহাপরিচালক এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন; তখন কথাবার্তায় মনে হয়েছে; তার চেয়ে সাধু পুরুষ আর কেউ নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্সের বক্তৃতা শুনতে শুনতে সবার কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতায় থাকার সময় মনে হয়েছে, দুর্নীতি করলেও এই বাংলাদেশে কেউ কখনো তার টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। কিন্তু বেনজীর ধরা খেয়ে গেছেন, উঁচুতলার রেষারেষির কারণে। এমন নয় যে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করে তার দুর্নীতি বের করেছে। গণমাধ্যমের একটি রিপোর্টেই খুলে গেছে বেনজীর দুর্নীতির প্যান্ডোরার বাক্স। মতিউর রহমানের কপাল তো আরো খারাপ। ছেলের কেনা ১২ লাখ টাকার ছাগল তার ১২ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য ধ্বসিয়ে দিয়েছে। এখানেও দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পরে গণমাধ্যম মতিউর রহমানের সম্পদের অঢেল খনি আবিস্কার করে। দুর্নীতি দমন কমিশন মরা সাপ পেটাতে খুব সফল। বেনজীর বা মতিউর দেশ ছাড়ার পর তারা দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে।s ss
চোরের মায়ের বড় গলা বলে একটা কথা আছে। বেনজীর বা মতিউরের গলাও কম বড় নয়। দুর্নীতির খবর প্রকাশের পরও এরা বড় গলায় কথা বলেন। বেনজীর যেমন স্মার্টলি সব অভিযোগ অস্বীকার করে ফেসবুকে লম্বা ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন। নিজেকে ধোয়া তুলসি পাতা দাবি করা বেনজীর বলেন, স্ত্রীর মৎস্য চাষ থেকেই তাদের সব আয়। এটা খুব মজার। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিত্তশালীর ট্যাক্স ফাইলে মৎস্য চাষ কমন থাকে। মাছ চাষে কর ফাঁকির সুযোগটা তারা নেন। তবে মৎস্য চাষের আয়ের অঙ্ক দেখে মনে হয়, পুকুরে চাষ করা মাছ স্বর্ণ দিয়ে বানানো। মতিউর অবশ্য বেনজীরের চেয়েও বড় স্মার্ট। ফেসবুক নয়, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ম্যানেজ করেন মূলধারার একটি গণমাধ্যমকে। মতিউরের দাবি তার সম্পদ এসেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে। লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারী যেখানে বারবার নিঃস্ব হয়, সেই শেয়ারবাজার থেকে মতিউর কোটি কোটি টাকা আয় করেন। আয় করার যে প্রক্রিয়াটা তিনি স্বীকার করেছেন, সেটা ধরেই তার বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার কারসাজির মামলা হতে পারে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি প্লেসমেন্ট শেয়ার নিতেন। তাছাড়া এনবিআরের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সুবাদে তিনি অনেক কোম্পানির ভেতরের খবর জানতেন। তাদের ডেকে এনে কম দামে শেয়ার কিনে কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করতেন। বেনজীর বা মতিউরের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া দেখে কেউ আবার মৎস্য চাষ বা শেয়ার ব্যবসা করে বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করবেন না যেন।
এই যে সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, এটা কি তাদের অভাবের কারণে? সরকারি চাকুরেদের বেতন অনেক বেশি নয়। তবে দফায় দফায় তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। তাতে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেতনের সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি বেড়েছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ সংসদে প্রশ্ন করেছেন, ‘‘সর

 

Post a Comment

0 Comments