ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি

 ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি


 গ্রামের মানুষের ঈদ সালামি দিতে হবে—এর জন্য কোটি কোটি টাকা জোগান দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। ব্যক্তিগত অনৈতিক কাজের জন্য ঘুষ দিতে হয়েছে, টাকা দিতে হয়েছে। নিজের কোম্পানির নামে জমি কিনতে হয়েছে, টাকা দিতে হয়েছে। ব্যাংকের শেয়ার কিনতে হয়েছে, তার জন্যও টাকা দিতে হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক যেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তার দখলে থাকা অন্য ছয়টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিও পূরণ করা হতো ইসলামী ব্যাংকের টাকা দিয়ে। কারো সঙ্গে কোনো ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব থাকলেও, তাদেরও এ ব্যাংক থেকে অর্থ দিয়ে মুখ বন্ধ করা হতো। এমনকি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ইসলামী ব্যাংক থেকে বেশি দামে ডলার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কম দামে বিক্রি করা হতো। এতে ব্যাংকটির বিশাল পরিমাণ অর্থ ক্ষতি হলেও কেউ মুখ খুলতে পারত না। এভাবে গত সাত বছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বের করে ব্যাংকটিকে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে আসা হয়েছে। এস আলমের অনৈতিক কাজগুলো যাতে কেউ বাধা দিতে না পারে, সে জন্য একটি অনুগত বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এ লক্ষ্যে তার পিএস আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনকে ডিএমডি পদে বসানো হয়েছিল।

চৌকস কর্মকর্তারা যদি তার কাজে বাধা দিতেন, তাদের চাকরি খেয়ে নেওয়া হতো। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এস আলম তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে এবং পাঁচ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করেছে। এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের সাত বছরের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে।

ইসলামী ব্যাংকের নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এনসিসি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। পর্ষদের অন্যান্য স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাব, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো: আবদুল জলিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম মাসুদ রহমান এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মো: আবদুস সালাম এফসিএ।

নতুন পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ লুটেরাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা ফেরত দিতে হবে; অন্যথায় তাদের হাতে থাকা ব্যাংকের শেয়ার দ্বারা সমন্বয় করা হবে। এর পরও যদি টাকা পাওনা থাকে, তাহলে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি দেশে থাকা তাদের সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা আদায় করা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ভয় দেখিয়ে বা অন্যভাবে যাদের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেওয়া হয়েছে বা দখল করা হয়েছে, তারা ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক হলে তাদের কাছে ব্যাংক ফেরত দেওয়া হবে। নতুন পর্ষদটি একেবারেই সাময়িকভাবে গঠিত হয়েছে।


ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এস আলম শুধু নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেননি, অফিস সহকারী থেকে ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। এদের বেশিরভাগই কোনো কাজ জানে না। এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন জনপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে এসব লোকবল নিয়োগ দিয়েছেন, যা ব্যাংকটির পরিচালন ব্যয়ও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে দেশি-বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে শেয়ার কেনা হয়েছে। তার এই কাজে সহযোগিতা করতেন কোম্পানি সেক্রেটারি জেকিই এম হাবিবুল্লাহ। এভাবে ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়েছেন এস আলম গ্রুপ, এবং সিঙ্গাপুরে বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যে পরিমাণ অর্থপাচার করা হয়েছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো জামানত নেই। এ কারণে ব্যাংকটি ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আরও জানান, ব্যাংক থেকে যাতে আর কোনো অর্থ বের করে নেওয়া না যায়, সে জন্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তবে তা সাময়িক। শেয়ার যেন হস্তান্তর না করা যায়, সে জন্য তার শেয়ার হস্তান্তরের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে যেসব কর্মকর্তাকে বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার লুটপাটের সহযোগীদেরও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এভাবেই ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে।


Post a Comment

0 Comments