‘হিন্দু হোস্টেল’ থেকে ‘ভারতীয় সেনা’—বাংলাদেশে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতে ফেক নিউজের বিস্তার

‘হিন্দু হোস্টেল’ থেকে ‘ভারতীয় সেনা’—বাংলাদেশে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতে ফেক নিউজের বিস্তার


 বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও তার সঙ্গে জড়িত সহিংসতার প্রভাব প্রতিবেশী ভারতের সামাজিক মাধ্যমেও পড়েছে। অনেক ছবি ও ভিডিওকে ওই আন্দোলনের ঘটনা হিসেবে দাবি করে বিভিন্ন পোস্ট ভারতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং এক্স (সাবেক টুইটার) এ ছড়িয়ে পড়েছে। এই পোস্টগুলোর অনেকটাই সাম্প্রদায়িক ও মিথ্যা দাবি সম্বলিত।
বিবিসির অনুসন্ধান এবং ভারতের নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং সাইটগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশিরভাগ ভিডিও পুরনো এবং ভুল প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিছু ভিডিও এবং ছবির ক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রদান করা হয়েছে অথবা এক ঘটনার ছবি অন্য ঘটনার সাথে জড়িত বলে চালানো হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ:
- “ঢাকার একটি ‘হিন্দু হোস্টেলে’ জামাতের আক্রমণের শিকার ছাত্ররা ছ’তলার ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলছে” বলে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, অথচ এই ভিডিওটি চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর হামলার দৃশ্য ছিল।



- “ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি” – এই স্লোগান দিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে, কিন্তু এটি গত জুনে ভারতকে ‘রেল ট্রানজিট’ দেওয়ার বিরোধিতার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির অংশ ছিল।
- ঢাকার রাস্তায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দু’জন বোরখা পরিহিত তরুণী পানির বোতল বিতরণ করছে বলে দাবি করা হয়েছে, যা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে ছিল।
এই মিথ্যা খবরগুলো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে এবং ভারতীয় হাই কমিশনার শেখ হাসিনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এর মধ্যে একটি ভিডিও, যা এক ছ’তলা ভবনের ছাদ থেকে লোকদের ফেলে দেওয়ার দৃশ্য দেখাচ্ছে, ভারতে “হিন্দু হোস্টেল ঢাকাতে” দাবি করে ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু আসলে এটি চট্টগ্রামের মুরাদপুরের ঘটনায় ঘটেছে। ভিডিওটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনার সাথে মেলে।
অতএব, এসব পোস্টের বেশিরভাগই ‘ফেক নিউজ’ হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
**মুরাদপুরের ভবন না ঢাকার ‘হিন্দু হোস্টেল’?**
সপ্তাহখানেক আগে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে একটি ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে একটি ছ’তলা ভবনের ছাদ থেকে কয়েকজনকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি পাশের একটি বহুতল ভবন থেকে মোবাইল দিয়ে ধারণ করা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে।
ভিডিওটির সঙ্গে লেখা বার্তায় দাবি করা হয়, “ঢাকায় একটি ‘হিন্দু হোস্টেলে’ জামাতের আক্রমণে হিন্দু ছাত্ররা কার্নিশ ধরে ঝুলছে। কতজন উপরে থেকে পড়ে গেছে, দেখুন!” 
এই ভিডিওটি ভারতে অন্তত আট-দশটি আলাদা আলাদা সোর্স থেকে আমার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে এসেছে। যারা এই ভিডিও পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সুপরিচিত শিক্ষাবিদ বা বুদ্ধিজীবী ছিলেন।
তবে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে বাংলাদেশের মূল ধারার গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, যা জানায় যে, ১৬ই জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীকে ফেলে দেওয়া হয়। 
রিপোর্টে বলা হয়, “কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মুরাদপুরের বেলাল মসজিদের পাশে একটি পাঁচতলা ভবনে আশ্রয় নেয়। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং ছাদে আটকে ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধর করে।” 
এই ঘটনার ফলে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী ছাদ থেকে পড়ে যায়। চট্টগ্রাম পুলিশ এই ঘটনায় ৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে।
বিবিসি ভিডিওটি যাচাই করে নিশ্চিত করেছে যে এটি আসলে চট্টগ্রামের মুরাদপুরের ঘটনারই। বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও পোর্টালে প্রকাশিত ছবির সঙ্গে মিলেছে ভিডিওটি।
অতএব, ভিডিওটি ঢাকার ‘হিন্দু হোস্টেল’র নয়। যারা নিচে পড়ছে, তারা মূলত ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থক, এবং তাদের হিন্দু পরিচয় এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। হামলাকারীরা জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিল এমন কোনও প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তথাপি, এই ভিডিওটি ভারতে সাম্প্রদায়িকভাবে বিকৃতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

Post a Comment

0 Comments