মতিউরের এত সম্পদ!

 মতিউরের এত সম্পদ!


ড. মতিউর রহমান ক্যাডার পরিবর্তন করে বাণিজ্য ক্যাডারের ১১তম ব্যাচ থেকে কাস্টমসের ১৩তম ব্যাচে যোগ দেন। নতুন ক্যাডারে যুক্ত হওয়ার পর তার প্রভাব, প্রতিপত্তি এবং সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে তার উত্থান শুরু হয়। বর্তমানে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য এবং কাস্টমস ও ভ্যাট আপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১৫ বছরে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন, যার মধ্যে পুঁজিবাজারে ব্রোকারেজ হাউসের অংশীদারত্ব, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, জমি ও বিনোদন পার্ক অন্তর্ভুক্ত। তার সন্তানদের নামে ডজনখানেক কোম্পানির মালিকানা রয়েছে।

মতিউর রহমানের দাবি, তার বিপুল সম্পদের মূল উৎস পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ। তবে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগও রয়েছে। এতদিন বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে '১৫ লাখ টাকার ছাগল' কাণ্ডে আলোচিত হওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। কালবেলার অনুসন্ধানে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের নানা তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মুসফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল কেনার ভিডিও পোস্ট করেন। এর পর জানা যায়, এই ইফাত কাস্টমস কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের ছেলে। এ ঘটনায় একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল পরিমাণ টাকায় গরু-ছাগল কেনা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে মতিউর রহমান দাবি করেন, মুসফিকুর রহমান ইফাত তার ছেলে নয় এবং তিনি তাকে চিনেন না। তবে এই ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে তার বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ড. মতিউর রহমানের উত্থান শুরু হয় ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক এক চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এনবিআর ও দুদককে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন, তবে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সম্প্রতি ইফাতের ছাগল কেনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মতিউর রহমান এই তরুণকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করলেও, ইফাতের সঙ্গে ভাইরাল হওয়া দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন তার পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা মতিউর রহমানের দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতার নামে রয়েছে। ইফাত যদি মতিউর রহমানের সন্তান না হন, তাহলে তার পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কীভাবে পেল—এমন প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
মতিউর রহমানের দাবি, তার সব সম্পদ বৈধ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার মাধ্যমে অর্জিত। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার ও বাইরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারত্বের নথিপত্র পাওয়া গেছে। গাজীপুরের গ্লোবাল সু এবং গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে তার দুই সন্তানের মালিকানা রয়েছে। মতিউর রহমান কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন এবং ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন কোম্পানিতে ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ শেয়ার রয়েছে।
মতিউর রহমান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকেন এবং তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসও ওই এলাকায়। তার ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি গাড়ির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যার দাম প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এসব বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ছেলের বাবা যদি মতিউর রহমান হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অস্বীকার করে ন্যক্কারজনক কাজ করেছেন। আর সম্পদ আড়াল করার জন্য বিষয়টি হয়েছে কি না—তা খতিয়ে দেখা দরকার। সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে, তারা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ তারা দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে মতিউর রহমান শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, এটা তার যুক্তি। এই যুক্তি তার আয়ের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা খতিয়ে দেখতে হবে।’

Post a Comment

0 Comments