"আমি আর কারও কাছে বিচার চাই না, শুধু আল্লাহর কাছে বিচার চাই।"
“রাতে পাঁচশ পুলিশ বাসা ঘেরাও করে। বাসায় আমরা পাঁচ/ছয়জন মহিলা শুধু। রাত তিনটা বাজে তখন। যে ঘরে শুয়েছিলাম সে ঘরের বারান্দার গ্রিলে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছিল। এর আগে দুই দিন না ঘুমানোতে তখন আমরা গভীর ঘুমে। অনেকক্ষণ পর যখন বের হই, বলে দরজা খুলেন। আমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেছে তারা।”
বিবিসি বাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিহত হওয়া ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা সামছি আরা জামান। যিনি নিজে একজন ক্যান্সারের রোগী।
নিহত প্রিয়র বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি
প্রিয় ‘দ্য রিপোর্ট’ নামে একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে সবশেষ ভিডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বেশ কিছু দিন মায়ের কাছে রংপুরে ছিলেন।
রংপুর থেকে ১০ই জুলাই রাতে ঢাকায় ফিরে আসেন। পরদিনই মায়ের সাথে শেষবারের মতো ভিডিও কলে কথা বলেছেন তিনি।
নিহত প্রিয়র সাথে থাকা সঙ্গীরা মিজ জামানকে জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিকেল পাঁচটা নাগাদ মারা যান তিনি। রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে সংঘর্ষ চলাকালীন তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
প্রিয়র মরদেহ ২১শে জুলাই রংপুরে নেওয়া হয়, সেখানেই দাফন করা হয় তাকে।
এরপর ওই দিনই মধ্যরাতে তার বাড়ি ঘেরাও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তল্লাশি চালায় র্যাব ও পুলিশ। বাসার একটি দরজাও ভেঙ্গে ফেলা হয় বলে অভিযোগ করেন মিজ জামান।
রংপুরের জুম্মাপাড়ায় দোতলা একটি বাড়িতে থাকেন মিজ জামান। পুরো বাড়িতে নিজেরাই থাকেন, কোনও ভাড়াটিয়া নেই বলে জানান মিজ জামান।
র্যাবের পোশাক পরিহিত অবস্থায় এ তল্লাশি চালানো হয়। যাদের ইউনিফর্ম ছিল না, তাদের হাতে বড় বড় হাতুড়ি ছিল বলে দাবি করেন তিনি। দরজা খুলে দিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তল্লাশির কোনও কারণ জানায়নি বলে তিনি জানান।
“দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় তারা বলে ঢং করেন? আপনি টের পান নাই, ঢং করেন? টের পান নাই আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন? কেন দরজা খুলব, এ প্রশ্ন করলেও তারা আমাকে কী কারণে, কেন আসছে বলেনি। চাবি খুঁজতে দেরি হচ্ছিল। তখন সাইডে একটা দরজা ছিল সেটা ভেঙ্গে তারা ছাদে উঠে যায়। পরে হাতুড়ি দিয়ে বড় দরজা ভাঙতে গেলে আমি বলি ভাঙতে হবে না। পরে দরজা খুলি”, জানান মিজ জামান।
মিজ জামানের স্বামী এক সময় রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও অনেক বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। সে দিন রাতে তল্লাশি হতে পারে এমন আশঙ্কায় ছিলেন না বাড়িতে।
কারণ রংপুর শহরে তখন বাড়ি বাড়ি ঢুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তল্লাশি করছিল বলে দাবি করেন নিহত প্রিয়র মা।
এখনও আতঙ্কে দিন কাটছে এই পরিবারের। রোববার দুপুরে যখন বিবিসি বাংলার প্রতিবেদকের সাথে কথা হচ্ছিল তখন জানান আবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসতে পারে বলে খবর পেয়েছেন।
মিজ জামান বলেন, “গতকালকে আবার খবর পেলাম তারা আবার আসবে। রাতেও ঘুমাতে পারিনি। সারা রাত জেগে ছিলাম। এতো পুলিশ, এতো র্যাব এইভাবে বাসায় হামলা চালায় আমার জানা নেই!”
এমন কী পার্শ্ববর্তী স্বজনদের বাসাতেও তারা প্রবেশ করে দশটি ফ্ল্যাটেই তল্লাশি চালায় বলে তিনি জানাে "ভাই গলি দিয়া যাইতেছিল, হুট কইরা একটা গুলি আইসা ওর পেটে হান্দে"
‘আল্লাহর কাছে বিচার দিছি’
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় ১৯শে জুলাই নিহত হন শিক্ষার্থী মাহমুদুর রহমান সৈকত। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সৈকত ছিলেন তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট।
সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে পরিবার থেকে জানানো হয়।
এরই মধ্যে সাতটি কলেজে চান্স পেয়েছেন, তবে সাবজেক্ট চয়েজ দেওয়ার পরে এখনও চূড়ান্ত ফলাফল বেরোয়নি।
ঘটনার দিন দুপুরে সৈকতের বাবা মাহবুবুর রহমান গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে সৈকত নিজেদের মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের দোকানে বসেছিলেন।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হলে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার জন্য বাবা ফোন করে তাকে বলেন বলে সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী জানান। অথচ আর বাসায় ফেরা হয়নি সেবন্তীর ছোট ভাই সৈকতের।
সেবন্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ও দোকান থেকে দৌড়ে এসে মাকে বলে আব্বু শাটার বন্ধ করতে বলছে। মা বলে জলদি বন্ধ করে আসো। ও দোকানের শাটার বন্ধ করছে। পরে কী হইছে দেখার জন্য ও একটু আগায় গেছে। ও দেখছে ওর বন্ধুর গায়ে গুলি লাগছে। তো সেই বন্ধুর কাছে গেছে। এরপরে কী হইছে আমরা আসলে জানি না। তার গায়েও গুলি লাগে। তার মাথায় গুলি লাগে।”
ভাইকে ফোনে দ্রুত বাসায় যাওয়ার কথা বললে সৈকত 'যাচ্ছি' বলে জানায়। একই সাথে দোকানের সামনেই রয়েছে বলে জানায়।
ছেলের বাসায় ফিরতে দেরি দেখে নামাজ পড়ে তার মা আর ফুফাতো ভাই খুঁজতে বেরিয়ে যান। এর মধ্যে একবার বোন সেবন্তী ও বাবার সাথে কথা হয়। পরে আর কারও ফোন ধরেননি সৈকত। কিছু দূর এগিয়ে টিয়ারশেল আর গুলির শব্দে বেশি দূর যেতে পারেননি তার মা।
এর মধ্যে সৈকতের বাবা মাহবুবুর রহমান অনবরত গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন করছিলেন ছেলের কাছে। এক পর্যায়ে ওই ফোন ধরেন অপরিচিত একজন।
“লোকটা ধরেই বলল আপনার ছেলে মারা গেছে। আব্বু বলে বাবা কী বল এই সব! উনি বলেন আপনারা কান্নাকাটি না করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন, কারণ লাশ পরে যদি না পান! আব্বু ভাইয়াকে (ফুপাতো ভাই) ফোন দিয়ে বলে সৈকত গুলি খাইছে। সোহরাওয়ার্দীতে নিয়ে গেছে”, জানান সেবন্তী।
এরপর দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন তিনি। সেখানে জরুরি বিভাগের মর্গে নিজের ভাইকে চিহ্নিত করেন। তার মাথার পেছনে একটা গুলির চিহ্ন ছিল বলে জানান সেবন্তী।
“১৯ তারিখে ঠিক তিনটা সাইত্রিশ মিনিটে তাকে গুলি করা হয়। আমি একটা ভিডিওতে দেখেছি।”
যাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন সৈকত, তাদের কাছেই বিচার চাইতে নারাজ সৈকতের পরিবার।
সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, “কার কাছে বিচার চাইব? যে আমার ভাই মারছে তার কাছে বিচার চেয়ে লাভ আছে? যে বা যারা আমার ভাইকে মারছে ... আমার ভাইকে তো পুলিশ গুলি করছে। এখন আমি থানায় যেয়ে পুলিশের কাছে বিচার চাইব? যে আপনারা আমার ভাইকে খুন করেছেন, আপনারা বিচার করে দেন?”
এ বছরে ১১ই সেপ্টেম্বর সৈকতের বিশ বছর বয়স পূর্ণ হতো।
“আমরা কোনও মামলায় যাইনি। কারণ পরে বলবে পোস্ট মর্টেম কর, এই কর ওই কর। আমাদের ভাইকে দাফন করে দিছি, কোন পোস্ট মর্টেম করিনি। আল্লাহর কাছে বিচার দিছি। আল্লাহ যা ভালো বুঝে তাই করবে”, বলেন সেবন্তী।
0 Comments