ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সম্প্রসারণের অন্যতম বড় বাধা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা হারুন।
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়ল’স লিমিটেড কারখানায় একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে বিধ্বস্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করেন। শুধু এই প্রতিষ্ঠানই নয়, পার্টেক্স, আম্বার ডেনিমস, দুলাল ব্রাদার্স, ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা প্রভৃতি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী থেকেও তিনি নানা অজুহাতে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করতেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিকৃত অর্থ দিতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং তাদের পরিবারকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতেন তিনি।
হারুন অর রশীদ এক দশক ধরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময়ে প্রায় তিন হাজার কারখানা থেকে তিনি অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও জানান যে, নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণে তিনি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে সাম্প্রতিক আলাপচারিতায় জানা যায়, পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অগাস্ট মাস এলেই ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী থেকে বড় অংকের চাঁদা নির্ধারণ করে দিতেন। নিয়মিত মাসোহারা এবং বিশেষ দিবসগুলোতে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করা হতো। কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন পণ্য উৎপাদনে গেলে বা ব্যবসা বাড়ালে, হারুনকে সেলামি দিতে হতো। অন্যথায় তিনি নির্যাতন, হামলা-মামলা এবং সামাজিকভাবে সম্মানহানি করতেন। দফা রফা না হলে, তিনি কখনও কখনও বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে কারখানায় হানা দিতেন এবং বিএনপি-জামায়াতের গোপন বৈঠক বলে গ্রেফতারের হুমকি দিতেন। প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বশে আনতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং কর্মীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
টাম্পাকো ফয়ল’স লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির মালিকের কাছে ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন হারুন অর রশীদ। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে, প্রথমে একজন পথচারীকে দিয়ে হত্যা মামলা করানো হয় এবং পরে পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সৈয়দ মকবুল হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়। পরে কর্মীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করানোর চেষ্টা চালানো হয়।
fff
পারটেক্স ডেনিম ও আম্বার গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও হারুনের লালসার শিকার হয়েছিল। ২০১৪ সালে পারটেক্স ডেনিমের কারখানা থেকে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে, টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে গভীর রাতে অবৈধভাবে কারখানায় হামলা চালানো হয়। আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলও জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর ধারাবাহিকভাবে নিপীড়ন চালিয়ে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে বাধা দেয়া হয়।
হারুন অর রশীদ ২০২২ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। করপোরেট অফিসগুলোয়ও নানা অজুহাতে হানা দিতে শুরু করেন এবং ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করতে ডজন খানেক সুন্দরী নারীর সহায়তা নেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও, যারা হারুনের হুমকির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ডিবিএল গ্রুপ ও ওপেক্স সিনহা গ্রুপের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা হয়। অনেক ব্যবসায়ী এখনো হারুনের নিপীড়নের শিকার হয়ে ট্রমায় ভুগছেন।
fff
হারুন অর রশীদ সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস শাখায় পদায়ন করা হয়। তারপর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর বিষয়ে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

0 Comments