"আমলাতন্ত্রের জালে বন্দী হাসিনার বিকল্প সরকার!"

 "আমলাতন্ত্রের জালে বন্দী হাসিনার বিকল্প সরকার!"


গত দেড় দশকে ক্ষমতার গণ্ডিতে বিশাল পরিবর্তন এনেছিলেন শেখ হাসিনা। এতে আইন প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই নিচ্ছেন আমলারা। তাদের দেখানো পথে মন্ত্রীরা চলেছেন, সরকারের কার্য সম্পাদন করেছেন। ফলে আমলারা শেখ হাসিনার দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। আর পদোন্নতি বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রেও তার বিশ্বস্ত আমলারাই পেয়েছেন অগ্রাধিকার। সরকারের প্রতিটি সংকটে, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমলারা ছিলেন সর্বাগ্রে এবং রাজনীতিবিদরা ছিলেন এর বাইরে। আমলারা কেবল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নেননি, সেই সিদ্ধান্তের বেশিরভাগের বাস্তবায়নও করছেন। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে তা করার কথা রাজনীতিবিদদের। এমনকি মহামারি চলাকালে লকডাউন দেয়া থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই প্রায় সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমলারা। আমলাতন্ত্র আসলে কী? আভিধানিকভাবে আমলাতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা, যাতে স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে সরকারের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। আমলারা জনপ্রতিনিধি নন বা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নন। 


fff


ফলে রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তিত হলেও আমলারা পদ হারান না। আমলাতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ বুরোক্রেসি। আর বুরোক্রেসির মূল উৎপত্তি ফরাসি শব্দ থেকে। ফরাসি বুরো শব্দের অর্থ ডেস্ক বা অফিস। গ্রিক শব্দ ক্র্যাটোস হলো শাসন বা রাজনৈতিক শক্তি। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ফরাসি অর্থনীতিবিদ জ্যাকুইস ক্ল্যঁদে ম্যারি ভিনসেন্ট দ্য গোউর্ন্যে প্রথম এই শব্দের প্রচলন করেন। তিনি স্যাটায়ার হিসেবে এই শব্দের প্রচলন শুরু করেন। যদিও বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র শেখ হাসিনার বিকল্প সরকার ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কারচুপি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দুর্নীতি, ব্যাংক-বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটসহ শেখ হাসিনা সরকারের অনেক অবৈধ কর্মকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন আমলারা। এসব আমলার বেশিরভাগেরই রয়েছে দেশের বাইরে প্রচুর সম্পত্তি ও দ্বিতীয় নাগরিকত্ব। ফলে চাকরি থেকে অবসরের পর অনেকেই দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। অন্যদিকে বিতর্কিত আমলাদের অনেকেই এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কয়েকজনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করলেও, বেশিরভাগ আমলাই এখনও চাকরিরত আছেন। এছাড়া অবসরে যাওয়া কেউ কেউ পাচ্ছেন নতুন করে পদায়ন। তাদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। তিনি সাবেক অর্থ সচিব এবং সরকারের সাবেক প্রধান হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ছিলেন। গতকাল তাকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে তিন বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মুসলিম চৌধুরী অর্থ বিভাগের সচিব থাকাকালে রিজার্ভ চুরি হয়। এছাড়া সিএজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় তার স্বাক্ষর ছাড়া সরকারের কোনো ধরনের তহবিল ছাড় করা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতির দায় তিনি এড়াতে পারেন না। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেন এবং সর্বজনীন পেনশন স্কিমও তার ব্রেইন চাইল্ড বলা হয়। আহমদ কায়কাউস, যিনি ছিলেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত আমলা। তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে লম্বা সময় দায়িত্ব পালন করেন। দরপত্র ছাড়া অর্ধশতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া এবং এসব লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অন্যতম হোতা ছিলেন তিনি। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বিশ্বস্ত এ সহচরকে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির মাস্টার মাইন্ডও বলা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেলেও বিদ্যুৎ বিভাগের ওপর তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী এ আমলা সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তার অঢেল সম্পদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠলেও, শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ আমলার দুর্নীতি নিয়ে কখনোই তদন্ত হয়নি। শহীদুল হক ছিলেন শেখ হাসিনার অন্যতম বিশ্বস্ত পররাষ্ট্র সচিব। ২০১২ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি তাকে বাংলাদেশের ২৫তম পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সচিব করা হলেও, একই বছর ১৯ জুলাই সচিব পদে ও ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সরকার তাকে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও, সরকার তাকে আরও এক বছরের জন্য একই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তিনি অবসরে যান। শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ পররাষ্ট্র সচিব দেশের স্বার্থবিরোধী অনেক চুক্তির মাস্টার মাইন্ড। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার, আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার, নামমাত্র ট্রান্সশিপমেন্ট মাশুল নির্ধারণে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। অবসরের পর তিনি আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) পরামর্শক পর্ষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। এ সময় সরকারকে পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শও তিনি দিয়েছেন। আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর অপসারিত হন। এর আগে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া বিপিসির চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ইউনূসকে একের পর এক আয়কর মামলায় হয়রানি করেন মুনিম। এছাড়া সামিট, এস আলম, ইউনিক, বেক্সিমকোসহ কয়েকটি বড় গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শত শত কোটি টাকার কর অবকাশ সুবিধা দিয়েছেন। এছাড়া বড় কয়েকটি কোম্পানিকে অবৈধভাবে কর সুবিধা দেয়া, টাকা পাচারে সহযোগিতা ও শুল্ককর ফাঁকিতে সহযোগিতা করে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন মুনিম। মো. জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন শেখ হাসিনার অন্যতম বিশ্বস্ত আমলা। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে কারচুপির সফল দায়িত্ব পালনের পুরস্কারস্বরূপ তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পদায়ন করা হয়। সেখানে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর সচিব করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ছাত্র হত্যার প্রত্যক্ষ মদদের ভিডিও ভাইরাল হলেও, তাকে কোনো ধরনের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এদিকে কবির বিন আনোয়ার ছিলেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও, শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে কখনোই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি। আওয়ামী লীগের তকমা লাগিয়ে যে কজন আমলা থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাদের মধ্যে কবির বিন আনোয়ার অন্যতম। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় ঢাকা, গাজীপুর, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ও এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক থাকাকালে তার আত্মীয়স্বজনদের ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন কবির বিন আনোয়ার। তাদের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আব্দুর রউফ তালুকদার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ দেয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শৃঙ্খলা নষ্ট করা, রিজার্ভকে রেকর্ড উচ্চতা থেকে তলানিতে নিয়ে আসা, রিজার্ভের হিসাব নিয়ে লুকোচুরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় নিরীক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে দেয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এ আমলার বিরুদ্ধে। এর আগে তিনি সাবেক অর্থ সচিব হিসেবেও বিতর্কিত ভূমিকা রাখেন। হেলালুদ্দীন আহমদ ছিলেন সরকারের ভোট কারচুপির আরেকজন যোদ্ধা। ইসি সচিব হিসেবে শেখ হাসিনার আস্থার প্রতিদান হিসেবে বিভিন্ন নির্বাচনে কারচুপিরর অন্যতম হোতা ছিলেন তিনি। এ দায়িত্ব সফলভাবে পালন করার পুরস্কারস্বরূপ ২০১৯ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিডি) সচিব করা হয়। ২০২০ সালে তাকে সিনিয়র সচিব করা হয়। ২০২২ সালে অবসরের পর তাকে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) পাঁচ বছরের জন্য সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি ওই পদেই বহাল আছেন।

Post a Comment

0 Comments