“দানবিক রাষ্ট্রের কারিগর”

 “দানবিক রাষ্ট্রের কারিগর”

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্যরা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শপথ নেন। ওই সময় থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ৭ মাস ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের অধীনে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সবগুলোই বিতর্কিত।

এই দীর্ঘ সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, বিরোধী মত দমন, সংবিধানের সংশোধন, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের অভাব, বিতর্কিত নির্বাচন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক সরকারের পদক্ষেপগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথও নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রাখতে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিরপেক্ষ থাকার কথা ছিল।



বিশ্লেষকরা বলেন, ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনকাল দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। দুর্নীতি ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করে পুরো ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্নীতির সুরক্ষাদাতা হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা হারানোর ভয় সরকার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে, তারা কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পুরো ব্যবস্থাকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দলীয়করণের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগসহ সকল প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের মাধ্যমে পেশাগত দেউলিয়াপনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। নির্বাচন কমিশন, দুদক, পিএসসি, মানবাধিকার কমিশন—সবগুলো প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিসহায়ক হয়ে পড়েছে।’

ক্ষমতার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নানা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন পদে দীর্ঘকাল ছিলেন। এদের মধ্যে সাবেক বিচারপতি, সেনাপ্রধান, সচিব, গভর্নর, ব্যবসায়ী, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানসহ অনেকেই রয়েছেন। 

আওয়ামী লীগ সরকারের দলের ব্যবস্থাপনাকে দলীয়করণ ও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম), যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসনবিষয়ক ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার তত্ত্বাবধানে প্রশাসনের ব্যাপক দলীয়করণ ঘটে এবং নির্বাচনে প্রশাসন ব্যবহারের বিষয়টি খোলাখুলি স্বীকার করেন।

এছাড়া, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করেন, এবং তার ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের শাস্তি এড়িয়ে সাহায্য করার অভিযোগ রয়েছে। 

তিনটি নির্বাচন কমিশনও ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল ছাড়া আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে জয়লাভ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিতর্কিত অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দল বর্জন করে।


ff f

বিদ্যুৎ খাতের দুরবস্থার জন্য সাবেক আমলা মো. আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউসকে দায়ী করা হয়। মো. আবুল কালাম আজাদ বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, এবং আহমদ কায়কাউস প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেন।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যবসায়িক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সরকার পক্ষের সঙ্গে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে সংযুক্ত রাখার চেষ্টা করেন এবং বিশেষজ্ঞরা তাকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের উদাহরণ হিসেবে দেখেন। 

আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার জন্য সাবেক গভর্নর ও অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার দায়ী। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পালিয়ে যান।

বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী লে. জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ, মেজর জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন এবং মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদীন গুমের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিরোধী দল দমন করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন।

এছাড়া, জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে নাগরিকদের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হয়। পুলিশের আইজিপি হিসেবে এ কে এম শহীদুল হক এবং বেনজীর আহমেদ বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের শিকার হন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এই কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। তারা নাগরিক স্বার্থের বিপরীতে সরকারের আদেশ পালন করেছেন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।’


Post a Comment

0 Comments