এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের বর্ণনায় ঢাকা মেডিকেলের ছয় দিন

 এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের বর্ণনায় ঢাকা মেডিকেলের ছয় দিন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনরাত কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত রোগীদের সেবা দিয়ে চলেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইন্টার্ন চিকিৎসক তাদের ছয় দিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন।  প্রথম আলো



১৫ জুলাই ২০২৪, সোমবার
একটি নিয়মিত ডিউটির মতোই দিনটি চলছিল। হঠাৎ খবর পেলাম, আমারই এক ব্যাচমেট কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ক্যাজুয়ালটি বিভাগে ছুটে গিয়ে দেখি, আমার চেনা ক্যাজুয়ালটিতে আমার ব্যাচমেটকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে প্রস্তুত ছিলাম না। তার মাথায় সাতটি সেলাই পড়েছে, এবং সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ধরা পড়েছে একটি ডিপ্রেসড ফ্র্যাকচার। এমনকি আরও কী হতে পারত, সেই ভাবনায় মগ্ন থাকা অবস্থায় ক্যাজুয়ালটির ছোট্ট রুমে একে একে আহত মানুষ আসতে শুরু করল। হাতে আঘাত, পায়ে জখম, মাথা-মুখে রক্ত। 
আমরা সবাই মিলে কাজ শুরু করলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে বুঝলাম, এটি শেষ নয়। আহত মানুষদের আসা অব্যাহত থাকল। অন্য ইন্টার্নরাও আসতে লাগল; কেউ রক্ত জোগাড় করছে, কেউ ইনভেস্টিগেশন লিখছে, কেউ স্টিচ দিচ্ছে, কেউ ড্রেসিং করছে।
আরও কিছু সময় পর, আহত আনসার ও পুলিশ সদস্যরাও আসতে শুরু করল। রাত ১০টা পর্যন্ত একটুও শ্বাস ফেলার সুযোগ পেলাম না। আস্তে আস্তে আহতদের সংখ্যা কমতে থাকল, এবং আমরা সবাই ততক্ষণে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অবিরাম কাজের ফলে খাবারও খাওয়ার সময় পাওয়া গেল না। কেউ খেতে গেল, কেউ একটু বিশ্রাম নিতে ডক্টরস রুমে চলে গেল। আমি ভয়ের চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্লান্ত শরীরে রাতটি কাটিয়ে দিলাম।



১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
সারা রাত জেগে থাকার পর বিকেলে ঘুম ভাঙল। কয়েক সেকেন্ড পরেই মনে হল, আজ ক্যাজুয়ালটির কী অবস্থা জানি না। একজন আমাকে বললেন, আজকের পরিস্থিতি গতকালের মতো নয়। রংপুরে আন্দোলন করতে গিয়ে আবু সাঈদ নামের এক ছাত্র মারা গেছেন। আমাদের জুনিয়ররাও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
১৭ জুলাই ২০২৪, বুধবার
নিয়মিত ডিউটিতে ক্যাজুয়ালটিতে পৌঁছলাম। মনে মনে দোয়া করছিলাম যেন সেই রাতের মতো পরিস্থিতি আর ফিরে না আসে। আজ অনেক আহত মানুষ এলেন, তবে সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ১৫ জুলাইয়ের পরিস্থিতি না দেখলে, আজকের আহতদের দেখে হয়তো আমি ভয় পেয়ে যেতাম।
১৮ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার
বৃহস্পতিবারের ডিউটি বরাবরের মতো বিশ্রামহীন ছিল। সকালের নাশতা না করলে বিকেলের আগে আর খাবার সুযোগ হয় না, তাই ক্যাজুয়ালটিতে যাওয়ার আগে দ্রুত নাশতা সেরে নিয়েছিলাম।
আজ পুরোপুরি শাটডাউন ছিল। সকালবেলায় পরিস্থিতি শান্ত ছিল, কিন্তু দুপুরের দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। আহতদের আগমন বাড়তে শুরু করল। এবার শুধু আহতই নয়, মৃতদেহও আসতে লাগল। একজন রোগী আমাকে আউটডোরের টিকিটটি দিলেন। রক্তমাখা সেই টিকিটে লেখা ছিল ‘স্প্লিন্টার ইনজুরি’। রোগীর পিঠ খুলে দেখলাম, ছোট ছোট ছররা পিঠ ভেদ করে ১২-১৩টি ক্ষত সৃষ্টি করেছে। স্প্লিন্টার ইনজুরি সম্পর্কে শুধু পড়েছি; তা-ও হয়তো পুরোপুরি মনে ছিল না। দ্রুত সিনিয়র আপুকে খুঁজে পেলাম। আপু আমাকে শিখিয়ে দিলেন যে, এই ছররাগুলো সারা জীবনের জন্য শরীরেই থেকে যাবে এবং এগুলো রুপালি গোল বলের মতো। এগুলো বের করতে গেলে মাসল বা অন্য জায়গায় চলে যায় এবং ধরা যায় না।
রোগীকে ড্রেসিং করে ওষুধ লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলাম, বাইরের অবস্থা কেমন?
রোগী থমথমে গলায় বললেন, ‘বাইরের অবস্থা ভালো না।’
হঠাৎ মনে হলো, কাঁদানো গ্যাস আর বম্ব ব্লাস্ট ইনজুরির চিকিৎসা তো অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। বইয়ের পিডিএফ খুলে চোখ বুলিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পরেই একটি বীভৎস চেহারার রোগী রুমে ঢুকল। এত বেশি বীভৎস যে, আমিই শুধু নয়, আশপাশের সবাই বুঝতে পারল, আজ কিছু খারাপ কিছু হতে চলেছে। লোকটির মাথার পেছনে গুলি লেগে চোখ ফুটো হয়ে বেরিয়ে গেছে। একটি চোখ বাইরে বেরোনো, মুখ ফুলে গেছে এবং নাক-মুখ দিয়ে ক্রমাগত ফেনা বের হচ্ছে। স্যাচুরেশন (অক্সিজেনের মাত্রা) মাত্র ৫৬ শতাংশ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওয়ান-স্টপ জরুরি সেবায় নিয়ে গিয়ে ইনটিউবেট করা হলো।
এরপর মাথায় গুলি, পায়ে গুলি লেগে এক পা উড়ে যাওয়া, হাতে গুলি লেগে রক্তপাত হওয়া, বুকে ছররা গুলি লেগে হিমোথোরাক্স, নিউমোথোরাক্সের রোগী, কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে ড্যাগার ঢোকানো রোগী, পেটের মধ্যে গুলি লেগে কিডনি ছিন্নভিন্ন হয়ে আসা রোগী, বাঁ পায়ের বাইরের দিকে গুলি লেগে তা ডান পায়ের বাইরের দিক থেকে বের হয়ে যাওয়া রোগী, পশ্চাদদেশে গুলি লেগে ব্লাডার ও ইউরেটার ছেদ হওয়া রোগী এবং নিহত মানুষের আগমন অব্যাহত থাকল।
এক দিনে মনে হলো, ১০ বছরের সমান হতাহত দেখেছি। এক অদ্ভুত অসারতা ভর করল। রক্তমাখা গায়ে হাত দিতে আর কাঁপল না, পায়ের মাংসের এক টুকরা অবশিষ্ট থাকা পা ড্রেসিং করতে আর ভয় লাগল না।
হঠাৎ খবর পেলাম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নিরাপত্তাবাহিনী হামলা করেছে। খবর পাওয়ার পরপরই চারপাশের ভিড় অতিরিক্ত বেড়ে গেল। স্বজন হারানোর আহাজারিতে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। আরও ইন্টার্ন সংগ্রহ করে জলদি রেড ক্রিসেন্টে ফোন দিলাম। তাদের ডাক্তার লাগলে আমরা প্রস্তুত জানিয়ে দিলাম। একদলকে ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হলো, আরেক দলকে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হলো, আরেক দলকে ব্লাড গ্রুপিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমরা ক্যাজুয়ালটি রুমে দায়িত্বে রইলাম। ডিরেক্টরের কাছ থেকে নির্দেশনা এল, সব ইন্টার্নকে ক্যাজুয়ালটিতে সহায়তা করতে হবে।

ff f


১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার
সকাল সকাল ক্যাজুয়ালটিতে পৌঁছে দেখি, গানশট ইনজুরির (গুলিতে জখম) খাতায় দুটি নতুন নাম উঠেছে। সারা দিন ও রাত গানশট ইনজুরির রোগীদের দেখলাম। সহজেই শিখে গেলাম, এন্ট্রি উন্ড (ক্ষত প্রবেশমুখ) ও এক্সিট উন্ড (ক্ষত নির্গমন মুখ) খুঁজে পেলেই রোগী যদি শারীরিকভাবে স্থিতিশীল থাকে, তাহলে ড্রেসিং করে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে। এক্সিট উন্ড না পেলে এক্স-রে করে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু গতকাল ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে ভিড় দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম, আজকের রোগীদের কোথায় ভর্তি দেব? ইতিমধ্যেই ডিরেক্টর স্যারের নির্দেশ এল, গানশট ইনজুরির রোগীদের জন্য সার্জারি ওয়ার্ডে ৫টি করে বেড খালি করতে হবে। আমরা এরপর সার্জারিতে ভর্তি দেওয়া শুরু করলাম।
ওয়ার্ডের ডাক্তারদের ওপর চাপ বেড়ে গেলে, আমরা নতুন পরিকল্পনা করলাম। সব রোগী তাত্ক্ষণিকভাবে চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ক্যাজুয়ালটি থেকেই পাবেন। আমরা ইন্টার্নরা কেউ ব্লাড রিকুইজিশন লিখলাম, কেউ এক্স-রে রিকুইজিশন, কেউ অর্ডার শিট, কেউ ইনজুরি নোট, কেউ রোগী রিসিভিংয়ের কাজ করলাম। কাগজের পাহাড়ে আমরা সব রিকুইজিশন ও অর্ডার শিট তৈরি করে রাখলাম, যাতে রোগী আসার পর কোনো সময় অপচয় না হয়। শুনলাম, ক্যাজুয়ালটির অপারেশন থিয়েটারগুলোতে জায়গা নেই, তাই নিয়মিত অস্ত্রোপচার বন্ধ রেখে আহত রোগীদেরও ওটি রুমে নেওয়া হলো। বড় স্যাররা সবাই অস্ত্রোপচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
রোগীদের আগমন কমছে না। দুটি স্ট্রেচারে দুই রোগী বুক চাপড়ে চিৎকার করতে লাগল, "আমাকে বাঁচান।" পালস অক্সিমিটার লাগাতে দেখা গেল, দুজনের স্যাচুরেশন ৪০-এর ঘরে নেমে এসেছে। অক্সিজেন দেওয়া হলো, বুকে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হলো, বাতাস আসছে না রক্ত আসছে। বাতাস এলে নিউমোথোরাক্স, রক্ত এলে হিমোথোরাক্স। এক্স-রে করারও সময় ছিল না। অক্সিজেন দিয়েও স্যাচুরেশন ৭০ শতাংশের উপরে উঠছিল না দেখে দ্রুত তাদের ভেতরের ওটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি দৌড়ে গিয়ে বুকে নল লাগানোর প্রস্তুতি নিলাম। র‍্যাপিড রেসপনস টিমের নার্স ও প্যারামেডিকেরা তাড়াহুড়ো করতে লাগলেন। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে বুকে নল ঢোকানো হলো এবং নলের ব্যাগে প্রায় অর্ধেক রক্ত ও বাতাস জমা হলো। আধঘণ্টার মধ্যে রোগীর স্যাচুরেশন স্বাভাবিক হয়ে এল। তাদের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে ফিরিয়ে নেওয়া হলো। রোগীর চাপ বাড়লে সার্জারি ওয়ার্ডও পূর্ণ হয়ে গেল। নতুন ওয়ার্ড খোঁজা শুরু হলো। এদিকে, ডিরেক্টর স্যারের নির্দেশে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রোগী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো।
রাত ১১টা। খবর এল, রাত ১২টার পর কারফিউ। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাসার মানুষ আমাদের খোঁজখবর নিতে কল করছিলেন এবং আমরা সঙ্গে সঙ্গে টিভির নিউজ জিজ্ঞেস করছিলাম।
রাত ১২টায় কারফিউ শুরু হলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, নিহতের সংখ্যা বাড়বে নাকি কমবে। গানশট ইনজুরির খাতার সন্ধ্যার কলাম বন্ধ করে রাতের কলাম খুলতে গিয়ে দেখলাম, সংখ্যা ৩০০-এর ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। রাতে ডিরেক্টর আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব, তা জানা নেই।


f ff


২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার
হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলাম, এখন আর কোনো ইউনিট বা ওয়ার্ড ভেদাভেদ নেই। সবাই একসঙ্গে ক্যাজুয়ালটি রোগীদের ওটিতে থাকব। ওয়ার্ডের কাজ শেষ করে ওটিতে গেলাম। চোখে পড়ল একটি চেনা মুখ। এত রোগীর ভিড়ে তাঁর নাম মনে করতে পারছিলাম না, কিন্তু তিনি আমাকে ঠিকই মনে রেখেছিলেন। যখন ব্যথায় কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি সেই রিকশাওয়ালা,’ তখন আর বুঝতে বাকি রইল না। এ সেই রিকশাওয়ালা, যিনি রুটিরুজির তাগিদে রাস্তায় বের হয়েছিলেন এবং এক হাত ও এক পায়ে গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। পরে এক পথচারী তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। আমি অনেক কষ্টে তাঁর ভাঙা হাড়গোড় পরিষ্কার করে ড্রেসিং করে ওয়ার্ডে পাঠিয়েছিলাম। 
আজ তাকে ওটিতে তুলতেই হাতের মেটাকার্পাল এবং পায়ের টিবিয়ার অর্ধেক নিঃশেষিত অবস্থায় দেখে সবাই ‘ইশ্‌’ করে উঠল। সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার আগে তিনি আমাকে বললেন, ‘হাত-পা না থাকলে আমি কী করে খাব?’
তার হাত-পা কেটে ফেলা অপরিহার্য, এটি জানিয়ে তাকে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হলো না।
আরেক ওটিতে গিয়ে দেখলাম, মাঝবয়সী এক পুরুষের পেটে গুলি লেগেছে। তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে দেখে মনে হলো, তাঁরা অবস্থাপন্ন পরিবারের সদস্য। আহতের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মেয়ের জন্য দুধ কিনতে বাসার পাশের দোকানে যাচ্ছিলেন, তখনই গুলিবিদ্ধ হন। গানশট ইনজুরির রোগী কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল ভর্তি নিতে চায় না। সবার শেষ আশ্রয় ঢাকা মেডিকেল। বুঝতে পারলাম, বিশাল ঢাকা মেডিকেলের আনাচকানাচে প্রতিটি ওটি রুমে এ ধরনের হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক গল্প জমা আছে।

Post a Comment

0 Comments