"শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা বলপ্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন।"
শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আরও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। দেশ ছাড়ার আগে, গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপ দেন তিনি। তবে পরিস্থিতি যে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেটি মেনে নিতে রাজি হননি। পরিবারের সদস্যরা বোঝানোর পর তিনি পদত্যাগে সম্মত হন। এরপর দ্রুত পদত্যাগ করে সামরিক হেলিকপ্টারে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গোপনে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।
শেষ মুহূর্তের একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, শেখ হাসিনা ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা হয়ে দিল্লি পৌঁছেছেন। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করছেন।
রোববার দিনভর দলীয় অস্ত্রধারী কর্মীদের নামিয়ে ব্যাপক সংঘাত ও প্রাণহানি সত্ত্বেও ছাত্র-জনতার আন্দোলন সামাল দিতে না পারার পর, রাতেই শেখ হাসিনাকে তাঁর একজন উপদেষ্টা এবং কয়েকজন নেতা সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেন। শেখ হাসিনা সে প্রস্তাব মানেননি; বরং সোমবার থেকে কারফিউ আরও কড়াকড়ি করতে বলেন। ভোর থেকে কারফিউ কড়াকড়ি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সকাল ৯টার পর থেকে আন্দোলনকারীরা কারফিউ ভেঙে নামতে শুরু করেন এবং ১০টার দিকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জমায়েত বাড়তে থাকে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ডাকা হয়। শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, সেই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আন্দোলনকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁজোয়া যানে উঠে লাল রং দিয়ে দিচ্ছেন এবং সামরিক যানে পর্যন্ত উঠে পড়ছেন—এগুলো দেখে কেন তারা কঠোর হচ্ছে না, সেটাও তিনি উল্লেখ করেন।
ff f
একপর্যায়ে শেখ হাসিনা আইজিপিকে দেখিয়ে বলেন, পুলিশ তো ভালো করছে। আইজিপি জানান, পরিস্থিতি এতটা গুরুতর যে, পুলিশের পক্ষ থেকে আর বেশি সময় কঠোর অবস্থান রাখা সম্ভব নয়। শীর্ষ কর্মকর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মানতে রাজি ছিলেন না। এরপর কর্মকর্তারা শেখ রেহানার সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে পরিস্থিতি জানিয়ে বড় বোনকে বোঝাতে অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা পরে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন, কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে অনড় থাকেন। পরবর্তীতে বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন। জয় তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন, এবং এরপর শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হন। তিনি তখন একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চান জাতির উদ্দেশে প্রচারের জন্য।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা শাহবাগ ও উত্তরা থেকে গণভবনের দিকে রওনা হয়েছে। দূরত্ব বিবেচনায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে শাহবাগ থেকে গণভবনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ভাষণ রেকর্ড করতে দিলে গণভবন থেকে বের হওয়ার সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। এই কারণে শেখ হাসিনাকে ভাষণ রেকর্ডের সময় না দিয়ে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এরপর শেখ হাসিনা ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে যান। সেখানে তাঁদের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হয়। পরে বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেলা আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে ছোট বোনসহ ভারতের উদ্দেশে উড্ডয়ন করেন শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, হেলিকপ্টারটি ভারতের আকাশে প্রবেশের পর কিছুক্ষণ উড্ডয়ন করে, পরে আগরতলায় বিএসএফের একটি হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। এরপর দিল্লি যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির কাছের গাজিয়াবাদে (উত্তর প্রদেশ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্দন বিমানঘাঁটিতে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে অবতরণ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা তাঁকে স্বাগত জানান। সেখান থেকে তিনি লন্ডনে যেতে পারেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এই বছরের ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে বিএনপি জয়ী হলে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে যায় এবং শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী হন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি, তিনি নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে 'ডামি' প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। সাত মাস পর ছাত্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে তিনি হেলিকপ্টারযোগে দেশ ছাড়েন।
0 Comments