"এস আলমের ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকে জমা ২৬ হাজার কোটি টাকা।"

 "এস আলমের ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকে জমা ২৬ হাজার কোটি টাকা।"


বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে ছয়টি ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। সাইফুল আলম, তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ভাই আবদুল্লাহ হাসানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এই অর্থ ব্যাংকগুলোতে জমা রয়েছে। এই ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটিই এস আলম গ্রুপের সরাসরি মালিকানায় অথবা নিয়ন্ত্রণে ছিল।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর অঞ্চল-১৫–এর এক অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে এই বিপুল অর্থের সন্ধান মেলে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ওই কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা ব্যাংকে জমা পুরো অর্থ কর বিভাগের আয়ত্তে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কর অঞ্চল-১৫ এস আলম পরিবারের সদস্য ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করে। সাধারণত ফাঁকি দেওয়া কর আদায়ের লক্ষ্যে হিসাব তলব করে কর বিভাগ।


এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের পর থেকে শুধুমাত্র এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের একাধিক হিসাবেই ৮৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা জমা হয়েছে।

ff f

গত পাঁচ বছরে ছয়টি ব্যাংকে থাকা এস আলম গ্রুপের মালিকপক্ষ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবগুলোতে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে, যার অধিকাংশই ঋণের অর্থ হিসেবে জমা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের পর থেকে শুধুমাত্র এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের একাধিক হিসাবেই ৮৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা জমা হয়েছে।


যে ছয়টি ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের বিপুল পরিমাণ টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ও আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটি ব্যাংকই সরাসরি এস আলম গ্রুপের মালিকানায় ছিল। এ ছাড়া আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকও ছিল এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। 


গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান। ওই সরকারের আমলে যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে, তাদের অন্যতম ছিল এস আলম গ্রুপ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ও রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে এস আলম ও তাঁর পরিবার গত এক দশকে ব্যাংক দখলসহ নানা ধরনের আর্থিক অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 


অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এনবিআর এস আলম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব তলব করে। দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাক বিভাগের ৯১টি প্রতিষ্ঠানের কাছে সব ব্যাংক হিসাব ও ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ওই ছয়টি ব্যাংক থেকে পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, এস আলম পরিবারের সদস্য ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকগুলোতে জমা আছে (স্থিতি) ২৫ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। 


* এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসের ব্যাংক হিসাবে ৮৩,৭০৬ কোটি টাকা ঢুকেছে। 

* এস আলমের ভাইয়ের হিসাবে আছে ১,৪৪৯ কোটি টাকা। 

* ২৬ হাজার কোটি টাকা জব্দের উদ্যোগ নিচ্ছে কর অঞ্চল-১৫। 


বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সরকারের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যাংক লুটপাট হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ লুটপাটে সহায়তা করেছে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নীরব ছিল। এই তিন পক্ষের মধ্যে অনৈতিক চক্র তৈরি হয়েছিল। এস আলম গ্রুপ যখন ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নিচ্ছিল, তখন বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। কারণ, সব পক্ষই সুবিধা পেত। 


এক কোম্পানিতে ৮৩,৭০৬ কোটি টাকা: এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেড। এস আলম গ্রুপের এ প্রতিষ্ঠানের কারখানা চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থিত। ২০০০ সালে এ কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০২০ সাল থেকে অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে ছয় ব্যাংকে এ প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা একাধিক হিসাবে ৮৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা জমা হয়েছে। 


তবে ছোট এই প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল অঙ্কের অস্বাভাবিক লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কর কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এটির বার্ষিক টার্নওভার মাত্র ৪০০ কোটি টাকা। সব ব্যাংকের হিসাব পাওয়ার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানো হবে বলে একাধিক কর কর্মকর্তা জানান। 

f ff

ভাইয়ের হিসাবে ১৪৪৯ কোটি টাকা: সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন, মা চেমন আরা, ভাই আবদুল্লাহ হাসান কর অঞ্চল-১৫–এর নিবন্ধিত করদাতা। গত মাসে এস আলমের মা–বাবা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে বা বোনের যৌথ নামে অথবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্যও তলব করা হয়। ছয়টি ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া হিসাব অনুসারে, আবদুল্লাহ হাসানের ব্যাংক হিসাবে এখন নগদ জমা (স্থিতি) আছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। 


অন্যদিকে এস আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীনের নামেও কয়েক শ কোটি টাকা আছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। 


এস আলম গ্রুপের ২ লাখ টাকার ঋণ: ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ একাই বের করে নিয়েছে বলে ব্যাংকটির নতুন পর্ষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। 


বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এই গ্রুপ সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে ঋণের অর্থে সাইফুল আলম ও তাঁর পরিবার সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

ff f

১৮টি কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকির তদন্ত: আয়করের পাশাপাশি এস আলম গোষ্ঠীর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তদন্ত করছে চট্টগ্রামের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট। 


এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেডের নামে ছয়টি ব্যাংকে বর্তমানে মাত্র ৪ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা জমা আছে। 

Post a Comment

0 Comments