খেলাপি ঋণ ‘মোটা তাজাকরণ’ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের জন্য অভিনন্দন।

 খেলাপি ঋণ ‘মোটা তাজাকরণ’ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের জন্য অভিনন্দন।

  • ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

  • ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

  • বাজেটে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য খেলাপি ঋণের সমান।


আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। বাজেট উপস্থাপনার দিনই জানা যায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বর্তমানে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

তবে এটি খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র নয়। লুকানো খেলাপি ঋণ বরং এর চেয়ে অনেক বেশি। অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা অর্থ ধরলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ হবে সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকার মধ্যে। নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ও ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কর্মসূচি রয়েছে, যা খেলাপি ঋণ ‘মোটা তাজাকরণ’ নামে পরিচিত। এই কর্মসূচি যে সফল হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ মাত্র তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এজন্য প্রথমেই অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশ ব্যাংককে।

এতে দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষকে সারা বছর ধরে যত বড় করের বোঝা মাথায় নিয়ে টিকে থাকতে হবে, ঋণখেলাপিরা ইতিমধ্যে সেই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়, আর এসব ঋণখেলাপিরা চাইলে এখন থেকে ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে তাঁদের কালোটাকা সাদাও করতে পারবেন। আত্মসাৎ করা অর্থ সাদা না করলেও কোনো সমস্যা নেই। ঋণখেলাপিদের জন্য নিত্যনতুন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তো আছেই।
m mm
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন ২ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক স্পর্শ করতে মাত্র ১৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা বাকি। বাংলাদেশ ব্যাংক যে গতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে, তাতে খুব বেশি সময় আর লাগবে না। যদিও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই বলা আছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইন প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে খেলাপি ঋণ আদায় নয়, বরং বৃদ্ধিটাই অব্যাহত থাকছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে, ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। তবে ঘটছে উল্টোটা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত বৃহস্পতিবার বাজেট দিয়েছেন, কিন্তু তাতে খেলাপি ঋণ নিয়ে কিছু বলেননি; বরং মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক নীতি বিবৃতিতে আশঙ্কা করা হয়েছে যে খেলাপি ঋণ কমানোর প্রক্রিয়ার সুফল পেতে সময় লাগবে।
mm m
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান খেলাপি ঋণের সমস্যা সম্পর্কে বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণের সমস্যা এক দিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরেই নানা কারণে হয়েছে।’ এই দীর্ঘদিনের বড় অংশ আসলে গত ১৫ বছর। এ সময়েই খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, সরকারের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে।

গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের পর প্রথমেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।

করোনা শুরু হলে সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয়। এতে কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঋণখেলাপিদের গণ ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা জারি করেন। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়।
m mm
নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ব্যাংকমালিকেরাই ঠিক করছেন কোন ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়েছে।

এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল করা হয়। সর্বশেষ ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে আরও এক দফা ছাড় দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেয়, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। এতে ঋণখেলাপি কোম্পানির নতুন ঋণ পাওয়ার দরজা খুলে যায়। এত সব ছাড় দেওয়ার কারণেই প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এই সরকারকে ‘খেলাপিবান্ধব’ সরকার বলতেন।

বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণখেলাপিদের যে গণ ছাড় দেন, তাতে প্রভাবশালীরা বুঝে যান যে কঠোর কোনো নীতি নয়, বরং ছাড়ই চলতে থাকবে। আর তার ফলাফল হচ্ছে খেলাপি ঋণের এত বড় বৃদ্ধি।

Post a Comment

0 Comments