বনশ্রী ও রামপুরার হাসপাতালগুলোতে আহত শিক্ষার্থীদের ভিড় জমেছিল।

 বনশ্রী ও রামপুরার হাসপাতালগুলোতে আহত শিক্ষার্থীদের ভিড় জমেছিল।


১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার। সকাল থেকেই বনশ্রী এলাকা উত্তাল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে শাটডাউন কর্মসূচি পালন করতে শিক্ষার্থীরা সড়কে নামেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে সর্বত্র। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বনশ্রীর আবাসিক এলাকার মোড়ে মোড়ে। তাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা। শিক্ষার্থীদের দমাতে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল আর ছররাগুলি ছুড়েন। এতে আহত হন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। নিহতও হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

গত দুদিনে বনশ্রী ও রামপুরা এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৮ই জুলাই আন্দোলনরত যে শিক্ষার্থীরা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তার সংখ্যা হাজারেরও বেশি। হাসপাতালের কর্মী ও স্থানীয়দের ভাষ্য, ১৮ ও ১৯শে জুলাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বনশ্রী ও রামপুরা এলাকা। বিজ্ঞাপন এসব স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মুহূর্তে মুহূর্তে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন অনেকে। বিশেষ করে ইটপাটকেলের আঘাত, টিয়ারশেলে আক্রান্ত ও ছররা গুলিতে আহতদের চিকিৎসা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে গুলিতে গুরুতর আহতদের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৮ই জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ চলাকালে সবচেয়ে বেশি আহত শিক্ষার্থী চিকিৎসা নেন বনশ্রীতে অবস্থিত ফরাজী হাসাপাতালে।

 এদিন বেলা এগারোটা থেকেই কারও মাথা ফাটা, কারও পায়ে গুলি লাগা, কেউ বুকে আঘাত পেয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। দিনের প্রথমভাগেই ৩শ’র বেশি আহত হয়ে হাসপাতালে আসেন। এ ছাড়া ওইদিন হাসপাতালটিতে একাধিক মৃতদেহ আসে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এর মধ্যে একজন গাড়িচালক বলে নিশ্চিত করেছেন ফরাজীর একজন কর্মকর্তা। ফরাজী হাসপাতালের কর্মকর্তা কৌশিক আহমেদ হিমেল মানবজমিনকে বলেন, সংঘর্ষ চলাকালে কতোজন এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কোনো ডাটাবেজ আমাদের কাছে নেই। সেদিন এত বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন যার হিসাব রাখা কঠিন ছিল। তবে যতদূর জেনেছি বৃহস্পতিবার (১৮ই জুলাই) ২৫০ জনের বেশি চিকিৎসা নিয়েছেন। মৃতদেহের বিষয়ে এই কর্মকর্তা তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, একজন গাড়িচালকের মৃতদেহ এখানে এসেছে। এ ছাড়া ১৯শে জুলাই আমার ডিউটি না থাকলেও দুটি মরদেহ আসতে শুনেছি। অবশ্য সেদিন আহতের সংখ্যাও অনেক ছিল। ১৮ই জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আহতদের সেবায় কোনো ফি নেয়া হয়নি জানিয়ে হিমেল বলেন, ওইদিন আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা কমপ্লিমেন্টারি ছিল। এ ছাড়া আফতাব নগর ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এলাকায় আমাদের দুটি মেডিকেল ক্যাম্পও করা হয়েছিল যাতে কেউ আহত হলে দ্রুত সেবা দেয়া যায়। ২ দিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে ফরাজী হাসপাতালে ভর্তি থাকা সদ্য নবজাতক জন্ম দেয়া নারী ফাহমিদা খানম মানবজমিনকে বলেন, আমি বুধবার হাসপাতালে ভর্তি হই। সিজার হয় ওই দিনই। পরদিন থেকেই একেকটা মিনিট যেন ভয়াবহতার মধ্যদিয়ে গেছে। একদিকে নতুন বাবু। অন্যদিকে বাসায় আমাদের প্রথম ছেলেকে রেখে আসি। হাসপাতালের চারপাশ থেকে শুধু গুলির শব্দ। আমার বাসা মেরাদিয়ায়। সেখানে আরও বেশি গোলমাল হয়। শুক্রবার দুপুর ১২টায় রিলিজ নেয়া হয়ে গেছে। এরমধ্যে ওই সময় শুরু হয় ব্যাপক গোলাগুলি। বাইরে মানুষ চিৎকার চেঁচামেচি করছিল। আর কিছুক্ষণ পরপর গুলির আওয়াজ। সেদিন দুপুর থেকে হাসপাতালে বসেই ছিলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে আমরা রাত দশটায় বাসায় ফিরতে পেরেছি। তখনও চারদিকে শুধু গোলমাল চলছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের পেছনের গেট দিয়ে কোনো মতে দুইটা অটোতে তুলে দিলে বাবার বাসায় গিয়ে উঠেছি। ফরাজী হাসাপাতালের পাশেই অবস্থিত অ্যাডভান্স হাসপাতাল। এখানেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ২ দিনে চিকিৎসা নিতে আসেন বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, বৃহস্পতি ও শুক্রবার আন্দোলনে আহত হয়ে অন্তত তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা নেন। হাসপাতালটির এক কর্মী বলেন, আমার দেখা মতে দুইশ তো হবেই। আরও বেশিও হতে পারে। ট্রিটমেন্ট দিতে দিতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে ওই ২ দিন। এই হাসপাতালে মারা যাওয়া কেউ আসেনি। তবে কয়েকজনকে দেখেছি ধরাধরি করে এম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিতে। গুলি খাওয়ার পর তাদের অবস্থা খুবই গুরুতর ছিল। রাজধানীর রামপুরার বেটার লাইফ হসপিটালটি প্রধান সড়কের ওপরই। বলা চলে ওই হাসপাতালের সামনেই ১৮ই জুলাই থেকে টানা চারদিন বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয়ে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছেন।

gg g

আহত হওয়া মাত্রই সেখানে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। হাসপাতালটির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই চারদিনে প্রায় চার শ’র বেশি মানুষ আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। রামপুরার আরেকটি হাসপাতাল হলো ডেল্টা লাইফ হসপিটাল। এখানে ১৮ই জুলাই আহত অবস্থায় ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থী এসেছিল। পরের দিন ১৯শে জুলাই বেলা দুইটার দিকে হাসপাতালে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তার বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর। ওই ব্যক্তির বাহুতে গুলি লাগে। এ ছাড়া শুক্রবার শতাধিক ব্যক্তি আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসেন বলে হাসপাতালটির একটি সূত্র জানিয়েছে। 

Post a Comment

0 Comments