বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ড কারাগার 'আয়নাঘর' যেন একেবারে দুঃস্বপ্নের মতো বাস্তবতা।

বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ড কারাগার 'আয়নাঘর' যেন একেবারে দুঃস্বপ্নের মতো বাস্তবতা।


 ভোর হওয়ার আগেই যখন জেলাররা কারাগারে ঢুকল, বন্দি ভাবল তার জীবনের এখানেই শেষ। আট বছর ধরে তাকে জানালাবিহীন, অন্ধকারময় আন্ডারগ্রাউন্ড কারাগারের ছোট প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয়েছিল, যেখানে রাতের কোনো শেষ নেই। কারাগারের রক্ষীরা তাকে তার প্রার্থনা শেষ করতে বলল। এরপর তারা তার চোখের বাঁধন এবং ধাতব হাতকড়া খুলে কাপড় দিয়ে তার কব্জি বেঁধে দিল। দুই লোক তাকে একটি মিনিভ্যানের মেঝেতে শুইয়ে দিল, যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায়। ঘণ্টাখানেকের যাত্রার পর, মীর আহমদ কাসেম আরমান ভাবছিলেন, অনেক রাজনৈতিক বন্দির মতো তাকেও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে ঢাকার প্রান্তে এক মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়।

দেশে অনেক কিছু বদলে গেছে: নতুন হাইওয়ে, পাতাল রেল, কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন সম্পর্কে আরমান জানতেন না—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি ১৫ বছর ধরে লোহার মুষ্ঠি আর প্রতিহিংসামূলক শাসন চালিয়েছিলেন, বিক্ষোভকারীরা তার বাসভবনে হামলা চালালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। হাসিনার প্রস্থানের পর ৫ আগস্ট আরমানসহ আরও কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরে গোপন কারাগারে আটক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে আধাসামরিক বাহিনীর হাতে নিখোঁজ হওয়ার সময় আরমান ছিলেন একজন স্বচ্ছল আইনজীবী, যার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অভিযোগ ছিল না। তবে ইসলামপন্থী কর্মী হিসেবে পিতার কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তার মুক্তির সময়, শরীর শীর্ণ, মুখে দাড়ি। ৪০ বছর বয়সী আরমান বলেন, “আমি প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম—যদি এই পৃথিবীতে না পারি, অন্তত স্বর্গে যেন আমার পরিবারকে আবার পাই।”

ff f

হাসিনার পতন বাংলাদেশের ১৭০ মিলিয়ন মানুষের জন্য নতুন স্বপ্নের সুযোগ তৈরি করেছে এবং দেশের সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে খারাপ অপব্যবহারের কিছু পর্দা উন্মোচন করেছে। একসময় গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে পরিচিত হাসিনা ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী শাসনে রূপান্তরিত হন, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জোরপূর্বক গুম। তার নিরাপত্তা বাহিনী অসংখ্য লোককে তুলে নিয়ে যায়, শত শত মানুষ গুম হয়ে যায়। অনেকেই হত্যা করা হয়, বাকিদের রাখা হয় গোপন সামরিক ডিটেনশন সেন্টারে, যেখানে ধীরে ধীরে তারা পাগল হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। সেই কারাগারের কোড নাম ছিল 'আয়নাঘর'।


এই গল্পটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর, যারা এখনও নিখোঁজ আপনজনের জন্য অপেক্ষা করছে। আরমানসহ অনেকের পরিবারের সদস্যরা এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিল, তাদের আশা ছিল হয় তাদের সন্তান ফিরে আসবে, নতুবা অন্তত ন্যায়বিচার পাবেন। 


বাংলাদেশের ইতিহাস বরাবরই রাজনৈতিক সহিংসতা এবং প্রতিহিংসার চক্রে আবর্তিত হয়েছে। হাসিনা তার ক্ষমতা ধরে রাখতে বিভিন্ন আধাসামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ছিল তাদের অন্যতম, যা সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী হিসেবে প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, কিন্তু পরে পরিণত হয়েছিল 'ইন-হাউস ডেথ স্কোয়াডে'। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণগুলো সরকারের নিষ্ঠুর শাসনের প্রতিচ্ছবি।


সামরিক বাহিনীও হাসিনার কঠোর শাসনে অংশ নিয়েছিল। সামরিক গোয়েন্দা শাখা দীর্ঘমেয়াদী বন্দিদের গোপন কারাগারে আটকে রাখার দায়িত্ব পালন করত। আয়নাঘরের বন্দিদের জীবনে কোনো আলো ছিল না, এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হতো। অনেকেই সেই দুঃসহ সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে ভাষা খুঁজে পান না। মুক্তি পাওয়া বন্দিরা বলছেন, সেই কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো, যেখানে একমাত্র সঙ্গী ছিল যন্ত্রণা আর অনিশ্চয়তা।

f ff

মীর আহমদ কাসেম আরমানের মতো লোকেরা শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেলেও, সেই অন্ধকার দিনগুলোর স্মৃতি তাদের জীবন থেকে মুছে যায়নি।

Post a Comment

0 Comments