ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা এখন খেলাপি ঋণের খাতায় চলে গেছে।

 ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা এখন খেলাপি ঋণের খাতায় চলে গেছে।


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিক ব্যাংক দখল করে ব্যাপক অর্থ লুটপাট করা হয়। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নেওয়া হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংককে এসব পরিস্থিতির মোকাবিলা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা বরং এই অনিয়মে সহায়তা করেছে এবং অনেক বড় খেলাপি ঋণ আড়াল করে রেখেছে। এর পাশাপাশি, এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতও ছিল না।


সরকারের পরিবর্তনের পর ব্যাংক ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা মালিকানা বদল হওয়ার পর আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী যেমন বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণও এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলস্বরূপ, ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, এবং সেপ্টেম্বর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। 

বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তা বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক যা করার, তা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঋণের খাত আড়াল করার জন্য সহায়তা করেছে।


ব্যাংকিং খাতে এসব ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচন করেছেন, ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন। তিনি বলেন, “২০১৯ সালে এক আজব নীতিমালার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করলে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাবে।” তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষা করা হচ্ছে এবং প্রতিটি ব্যাংকের নিজের উদ্যোগে এ ধরনের নিরীক্ষা করা উচিত।”


বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। এরপর সেপ্টেম্বর শেষে এটি প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার সময় ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা ছিল। 

f ff

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ গোপন রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছিল। তবে, নতুন সরকারের নির্দেশনায় এখন প্রকৃত তথ্য উন্মোচিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দিলে, তার একটি শর্ত ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে, কিন্তু বাস্তবতা তাতে পুরোপুরি বিপরীত।


এস আলম গ্রুপের সাতটি ব্যাংকে আমানতের বড় অংশ ঋণ হিসেবে নাম-বেনামে বের করা হয়েছে, এবং এসব ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে অনেকেই ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়ে গেছে, ফলে তাদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি, যাতে পরবর্তী সময়ে এরূপ দুর্নীতি ঠেকানো যায়। 

f ff

একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জন্য একের পর এক ছাড় দিয়েছে, অন্যদিকে কিছু বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বেশি ঋণ দেওয়ার জন্য আইনি শিথিলতা আনা হয়েছে। ২০১৫ সালে সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়, এবং ২০১৯ সালে ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারির পর বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ স্থগিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যা খারাপ ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি সহায়ক হয়েছে।


এই পরিস্থিতিতে, দেশে ঋণখেলাপির খাতা আরো বিশাল হয়েছে এবং কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

Post a Comment

0 Comments