আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কেন ভুলে যাওয়া উচিত নয়
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত প্রথম ব্যক্তি। তার মামলাটি দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ন্যায়বিচারের প্রতি গুরুতর এক বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য সরকার সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করে এবং তার প্রাথমিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তৈরি করে। তৎকালীন আপিল বিভাগ সরকারী অভিপ্রায়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতি ও প্রমাণের পুনঃমূল্যায়ন করেছে।
২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনী বছর, এবং তৎকালীন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডকে ‘জাতির জন্য উপহার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। আপিল বিভাগের একটি সংক্ষিপ্ত আদেশের ভিত্তিতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই মামলার প্রতিটি পদক্ষেপ বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল যাতে রায় দেওয়ার দিনেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়। অভিযুক্তকে কখনোই পূর্ণাঙ্গ আদেশ দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি, যার ওপর ভিত্তি করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এটি তৎকালীন আপিল বিভাগের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা, যা ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে গুরুতর অবহেলার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
এই ডিসেম্বরে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ১১তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। যারা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করার কথা বলছেন, তাদের জন্য মোল্লার মামলা স্মরণ করা অত্যন্ত জরুরি। তার মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র একটি ত্রুটিপূর্ণ ও পুরানো আইনের ফসল ছিল না, বরং এটি একটি পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থার ফলস্বরূপ।
মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সাজা দেয়ার সময় প্রমাণ ছিল খুবই সীমিত। তার বিরুদ্ধে অধিকাংশ প্রমাণ দুর্বল ছিল এবং জেরা ও প্রমাণ-পরীক্ষায় তা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় একক অভিযোগের ভিত্তিতে এবং একটি অবিচারপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক আইনের সাথে এই বিচারের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক আইন এড়িয়ে গিয়ে একটি নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পরিপন্থী ছিল।
f ff
এছাড়া, মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণের সময়ও বিচারপ্রক্রিয়া পরিবর্তন করা হয়েছিল, যাতে অভিযুক্তের পক্ষে সঠিক প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয়। এই ধরনের প্রক্রিয়া একটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং অসাংবিধানিক রায় তৈরি করে, যা আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের জন্য একটি বিপর্যয়।
মোল্লার মামলা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান প্রসিকিউটররা আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের সঠিক প্রয়োগের জন্য কাজ করছেন। নতুন ট্রাইব্যুনালকে অবশ্যই পূর্ববর্তী বিচারব্যবস্থার ভুল সংশোধন করতে হবে, যাতে আগামীতে ন্যায়বিচারের জন্য পদ্ধতিগত বাধা দূর করা যায়। যারা আইনের সংশোধন দাবি করছেন, তাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, ন্যায়বিচার শুধু বর্তমানের জন্য নয়, অতীতের ভুলও সংশোধন করতে হবে।
0 Comments