দুর্নীতির দায়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের এমডি অপসারণ
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই), বাংলাদেশ ব্যাংক আজ একটি চিঠির মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে তার পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
২০১৫ সালের ৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনে ওয়াসেক মো. আলী ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তার চুক্তির মেয়াদ দুইবার বাড়ানো হলেও, সময়ের সাথে সাথে তার কর্মকাণ্ড ব্যাংকের সংকটের মূল কারণ হয়ে ওঠে।
তার বিরুদ্ধে ধরা পড়ে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ—বেনামি ঋণ বিতরণ, আমানত-লুট, জাকাত তহবিল অপব্যবহার, বিনিয়োগ ও ঋণ দেওয়ার সময় যথাযথ যাচাই-বাছাই বা জামানত গ্রহণ না করা, সীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত বিনিয়োগ, বন্ধকি সম্পত্তির অতিরিক্ত মূল্যায়ন, স্থায়ী আমানতের বিরুদ্ধে বেআইনি উত্তোলন, ও অতিরিক্ত মুনাফার বিতরণ—ফলে ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব অভিযোগ তদন্তে সত্যতা পাওয়া যায়।
f ff
বর্তমানে তিনি বাধ্যতামূলক ছুটিতে ছিলেন—২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে।
গেল জুনে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও পরিচালনা পর্ষদ তাকে এমডির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে। সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ (১৫ জুলাই) আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে অপসারিত করেছে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পেয়েছি। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
📌 প্রেক্ষাপট ও বিস্তারিত
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ইসলামী ব্যাংকগুলোতে নতুন পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগ হয়। ফার্স্ট সিকিউরিটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাত ধরে, যার সঙ্গে ওয়াসেকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
নতুন পরিচালনা পর্ষদের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় দেখা যায়, ২০২৫ সালের ১ জুন অনুষ্ঠিত ১০৭তম অডিট কমিটির সভায় এমডির বিরুদ্ধে বহু অনিয়মের বিস্তৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
তথ্যসমূহ:
-
বড় অঙ্কের ঋণ এবং বিনিয়োগ অজানা ব্যক্তি বা কোম্পানির নামে, যেখানে যথাযথ কাগজ, জামানত বা যাচাই-বাছাই ছিল না
-
এমডি নিজস্ব মর্জিমতো নিয়োগ ও পদোন্নতিতে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব
-
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও একজন নির্বাহীকে ১১ মাস অবৈধভাবে রেখে অতিরিক্ত বেতন–বোনাস
-
জাকাত ফান্ডে স্বচ্ছতার অভাবে অনিয়ম; ধর্মীয় উদ্দেশ্যেও আঘাত
-
অতিরিক্ত বিনিয়োগ, সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন, বেআইনি উত্তোলন ও বেশি মুনাফা—সবই ব্যাংকের আর্থিক দুর্বলতা বাড়ায়
ফল: চরম তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা এবং বিপুল প্রভিশন ঘাটতি—যাতে আমানতকারীদের আস্থা টলমল করে।
🏦 কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ
২০২৫ সালের ১৮ জুন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশ ব্যাংকে এমডি অপসারণের সুপারিশ পাঠায়। তারা জানান, “ওয়াসেক এমডির অদক্ষতা ও পরিচালনায় ব্যর্থতা ব্যাংকের বিশ্বাস ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে।”
এর পর্যালোচনার ভিত্তিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক আজ ১৫ জুলাই তার অপসারণ অনুমোদন করে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১৫ (ক) (২) ধারার অধীনে নতুন এমডি নিয়োগের নির্দেশ দেয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “চিহ্নিত অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে।”
🌐 ঝুঁকির প্রভাব
ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করে, বলেন:
“সৈয়দ ওয়াসেকের সময় ব্যাংকের না শুধু আর্থিক স্বচ্ছতা হারিয়েছে, বরং ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নৈতিকতা ও শৃঙ্খলাও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, এমডি পর্যায়ের এসব অনিয়ম বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে—যদি দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে পুরো খাতের ওপর প্রভাব পড়বে।
💰 ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী:
-
আমানত সংগ্রহ: ৪৩,১৪৩ কোটি টাকা
-
ঋণ বিতরণ: ৬০,৯১৫ কোটি টাকা
-
খেলাপি ঋণ: ৫৮,১৮২ কোটি টাকা (যা প্রায় সম্পূর্ণ ঋণের সমপরিমাণ)
-
পরিশোধিত মূলধন: ১,২০৮ কোটি টাকা
-
বর্তমান লোকসান: ৪০৫ কোটি টাকা
-
মোট শাখা: ২০৬টি
0 Comments