"বানোয়াট পরিসংখ্যানের মূল পরিকল্পনাকারী লোটাস কামাল"

"বানোয়াট পরিসংখ্যানের মূল পরিকল্পনাকারী লোটাস কামাল"


সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে, অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও দেশে প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ২০১৪ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরও প্রকট হয়ে ওঠে। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রক্রিয়ায় পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। অভিযোগ ওঠে, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। এ সময় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও পরিসংখ্যানগত পার্থক্য বাড়তে থাকে। এই প্রবণতা আওয়ামী লীগ সরকারের পরবর্তী সময়েও অব্যাহত ছিল। বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে শুধুমাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল। এসব বানোয়াট পরিসংখ্যানের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল, যিনি লোটাস কামাল নামে পরিচিত, তাকে দায়ী করা হয়।

আ হ ম মুস্তফা কামাল ১৯৭০ সালে পুরো পাকিস্তানের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে কমার্সে স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। আইন শাস্ত্রেও তার স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ শিক্ষাজীবনেই তিনি ‘লোটাস’ উপাধি পান, কিন্তু অনেকে মনে করেন, তিনি তার জ্ঞানকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আবার ক্ষমতায় এসে পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালকে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা, যাকে মিথ্যা তথ্য তৈরির পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়।

 

 


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের পরিসংখ্যান, যা পরিচালিত হতো শীর্ষ পর্যায় থেকে। ফলে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো, কিন্তু সামষ্টিক তথ্যের সঙ্গে যার কোনো মিল ছিল না। মূলত রাজনৈতিক কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে সরবরাহ করা হয় বিকৃত পরিসংখ্যান। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণের কারণেই দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে বিশ্বব্যাংক। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০ এর মধ্যে ৮০। কিন্তু এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সেই স্কোর দ্রুত কমে ৬২-তে নেমে যায়, এবং ২০২০ সালে তা আরও কমে ৬০-এ পৌঁছায়, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সেই সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের সব ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করে। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিবিএসে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় সংস্থাটির মাধ্যমে নিয়মিত মাসিক মূল্যস্ফীতি প্রকাশের দায়িত্বও তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। পরবর্তী সময়ে বিবিএসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিপিআই শাখার জনবলেও পরিবর্তন আনা হয়। পদায়ন করা হয় মুস্তফা কামালের আশীর্বাদপ্রাপ্তদের। তৎকালীন মন্ত্রীর এসব কাজ দেখভাল করতেন মাসুদ রানা চৌধুরী নামে অর্থনৈতিক ক্যাডারের এক বিশেষ সহায়ক। তার মাধ্যমেই মুস্তফা কামাল যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিবিএসের বর্তমান ও সাবেক পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটিতে কথা বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ ন্যূনতম আপত্তি তুললে বা কথা বলার চেষ্টা করলে ঢাকার বাইরে বা কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় বদলি করে দেওয়া হতো। এমনকি বিনা কারণে হয়রানির জন্য বিভাগীয় মামলাও করা হয়। সংস্থাটির বিভিন্ন শাখা থেকে শুরু করে উপমহাপরিচালক ও মহাপরিচালক হয়ে সচিবের দপ্তরে চলত পরিসংখ্যান ইঞ্জিনিয়ারিং। এমনকি কখনো কখনো মূল্যস্ফীতির এসব ফাইল মন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনও নিতে হতো, অথচ বিধি অনুযায়ী বিবিএসের সব তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব মহাপরিচালকের।

তৎকালীন বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যগত পার্থক্য বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান মুস্তফা কামাল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.৪ শতাংশ, যদিও লোটাস কামাল ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭.৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করেন। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে বড়জোর ৬.৬৫ শতাংশ। এডিবিও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে।

এই পরিস্থিতিতে, ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের ডাটাকে চ্যালেঞ্জ করে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের ডাটাই সঠিক।’ সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংককে ‘আলটিমেটাম’ দিয়ে বিবিএসের সঙ্গে বসে ডাটা সংশোধনের জন্য সময়ও বেঁধে দেন পরিকল্পনামন্ত্রী। এমনকি নিজে ফোন করে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের দ্রুত সংশোধনের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের তৎকালীন মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ওই সময়ে সরকারি প্রবৃদ্ধির হিসাব মেলানো যাচ্ছিল না। আমরা বিভিন্ন মডেল দিয়ে এর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলাম। এতে মন্ত্রী মুস্তফা কামাল ক্ষিপ্ত হয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরকে ফোন করে বিবিএসের তথ্য সঠিক বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ২০১৫-১৯ সালের সময়টায় সরকারি প্রবৃদ্ধির হিসাবের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশের হিসাব মিলছিল না, যা ব্যাখ্যার অযোগ্য ছিল। কিন্তু সম্পর্কের অবনতি এড়াতে আমরা সরাসরি তা বলিনি। ২০২২ সালে অবশ্য আমাদের একটি রিপোর্টে বিষয়টি আকারে-ইঙ্গিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।’

তথ্য বিভ্রান্তির পরিণাম সম্পর্কে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এটা চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর মতো। ডাটা বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। কোন ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবেন, তা পরিসংখ্যান বলে দেয়। কিন্তু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করলে আপনি কোথাও না কোথাও ধাক্কা খাবেন, যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া রাজস্ব ও রফতানিসহ সব পরিসংখ্যানের মধ্যেই দূষণ ধরা পড়ছে।’

 

 ff f

২০২২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম–চেঞ্জ অব ফ্যাব্রিক’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য বাড়তে থাকে। তবে ২০১৫-১৯ সময়ের মধ্যে এই পার্থক্য ৩.৭ শতাংশে উন্নীত হয়, যা ব্যাখ্যার অযোগ্য।

লোটাস কামালের সময় বিবিএস একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো বলে অভিযোগ করেন সংস্থাটির পরিচালক আব্দুল কাদির মিয়া। তিনি বলেন, ‘পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দীপংকর রায়ের মাধ্যমে পাঁচ-ছয়জনের সিন্ডিকেটের একটি বলয় তৈরি করে বিবিএস পরিচালিত হতো। এমনকি কয়েকবার বদলির আদেশ ঠেকিয়ে এই কর্মকর্তাকে বিবিএসে রাখা হয়। কেউ তাদের কাজে প্রশ্ন তুললে বিভিন্ন রাজনৈতিক ট্যাগ দেয়া হতো। মূল্যস্ফ
 

Post a Comment

0 Comments